ছোট গল্প:শেষ হয়েও হইলো না শেষ

           ছোট গল্প

প্রচণ্ড বৃষ্টি।অফিসের সময় শেষ হয়েছে অনেক্ষণ হল।বৃষ্টির জন্য কেউ বের হতে পারছিল না।আজ দুপুর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে কাপড় ভিজে যেমন নেতিয়ে যায় মানুষগুলোকে তেমনই লাগছিল।যেন শ্রান্তির বর্ষণে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর।কেউ ঝিমাচ্ছে, কেউ খণ্ড খণ্ড আসর জমেছে আর কেউ মোবাইলে প্রিয়জনের সাথে কথা বলছে,দ্রুত বাড়িতে ফিরে যাবার আশ্বাস দিচ্ছে।


বৃষ্টি দেখলেই আমার মনটা অজানা কারণে অস্থির হয়ে উঠে।ইচ্ছে করে আকাশের মত গর্জে গর্জে কাঁদি।আজও একি রকম লাগছিল।একা বসে না থেকে আমি একখণ্ড আসরে বসে পড়লাম।সবাই গল্প বলছে।তাদের গল্প শুনে বুঝতে পারছিলাম তাদের কেতাবি জ্ঞান ঢের বেশি।তাই তাদের সব কথা ধরতে পারব না এইভেবে উঠতে চাইতেই আমাকে তারা চেপে ধরল গল্প বলার জন্য।আপনারা তো জানেনই আমার রসজ্ঞান সম্পর্কে।তাছাড়া গুনের মধ্যে আমার একটাই গুণ আছে সেটা হল নির্গুণ। 


তাদের হাত থেকে পালাতে আমি বললাম,"দেখ, ভাই।আমি তোমাদের মত কবি-সাহিত্যিকও নই, দার্শনিকও নই আর সমালোচক তো নই।আমাকে মাফ করো"।


কিন্তু সবাই কাঁঠালের আঠার মত লেগে রইলো। আমি অগত্যা বললাম,"ঠিক আছে, শুনো। একটি গল্প বলছি।একদম গল্পের মত সত্যি।"


সেদিন ছিল ছুটির দিন।সেইবার ইদের ছুটি আর দুর্গাপূজোর ছুটি এক সাথে পড়েছে।সে ছুটিতে ঢাকা শহরের অবস্থা দেখলে মনে হত ইতিহাসের বইয়ে পড়া মহামারিতে আক্রান্ত কোনো শহর।সেই শহরে রোদন করার মানুষ পর্যন্ত নেই।সন্ধ্যে হলে সেখানে নিজের ছায়া দেখেই আঁতকে উঠত প্রাণ।আমার কথা শুনে একটুও অবাক হয়ো না।আমার কথায় বিশ্বাস না থাকে তো যারা সেই সময়ের ঢাকা দেখেছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।


সেই সময়ে ঢাকায় সূর্য ডুবলে মনে হত মাঝরাত।অন্ধকারের চাদর এমন ভাবে ঢেকে দিত যারা সেই অন্ধকার একবার দেখেছে তারা হলফ করে বলত আর বোধহয় কখনো তারা আলোর দেখা পাবে না অথচ ব্যস্ত এই শহরের নামে কথিত আছে এই শহর কখনো ঘুমায় না।


সেই শহরে আমি ছিলাম এক অভিবাসী। থাকতাম চাচা-চাচীর সাথে।শৈশবে বাবা-মা  দূর্ঘটনায় মারা যান।এই যে আমার কপালে যেই চিহ্নটা দেখছ, ঠোটের কাটা দাগ সবকিছু সেই দূর্ঘটনার আশীর্বাদ।তখন থেকেই নিঃসন্তান এই দম্পতি তাদের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করেছে।আমার উচ্চ শিক্ষার জন্য তারা আমাকে দেশের বাহিরে পাঠিয়েছেন।সেই বছর তারা হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে তীর্থযাত্রা করেন।তখন আমি দেশে।পুরো বাড়িতে আমি একা।তাদের দীর্ঘদিনের পুরাতন কাজের মহিলাটা আমার জন্য প্রতিদিন দুপুরে রান্না করে দিয়ে যেত তা দিয়ে আমার তিন বেলার আহারের বন্দোবস্ত হয়ে যেত।সারাদিন একা বাসায় থাকতে থাকতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।বিদেশে থাকার কারণে দেশে বন্ধুর তালিকা ছিল সংক্ষিপ্ত আর সেই তালিকার কারো সাথেই ছিল না নিয়মিত যোগাযোগ।


তখনকার প্রত্যেকটি দিনই ছিল আমার কাছে একই রকম। সকালে বেলা করে উঠা,নিজেই হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করা,এর মাঝে সালেহা খালা এসে পড়ত।সালেহা খালাকে তো চিনতে পেরেছেন? উনিই সেই পুরাতন কাজের মহিলা।এরপর আমার ডিপার্টমেন্টের এক দুইটা বই ঘাটাঘাটি করে দুপুরে খেয়ে আবার ঘুম দিতাম।বিকেলে আসর নামায পড়তে মসজিদে যেতাম।এমনিতে আমি নিয়মিত নামায পড়তাম না। কিন্তু তখন আমি আসর-মাগরিব নিয়মিত মসজিদে পড়তাম এই আশায় যে,মানুষের দেখা মিলবে।এরপর মাগরিব পর্যন্ত বাহিরে হাটাহাটি করতাম এরপর মাগরিব পড়ে বাসায় আসতাম। এরপর গিয়ে কম্পিউটারে গেম খেলে যতটা রাত করা যায় করতাম এরপর কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম।এভাবেই দিন হত,এভাবেই রাত যেত।


যতদিন যাচ্ছিল আমি তত বেশি একাকিত্বের মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম।আমার ভিতরে মানুষের উপস্থিতি পাওয়ার তৃষ্ণা এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমি ভিতরটা হাহাকার করত। 


সালেহা খালা মাঝে মাঝে উনার ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আসতেন।ছেলেটার বয়স ৪ বছর হবে। নাম মাসুম। দেখতেও খুব মিষ্টি যেদিন মাসুম তার মায়ের সাথে আসত সেদিন আমরা একসাথে কিছু সময় কাটাতাম।মাসুম যখন আসত আমি তখন নানান জিনিসের লোভ দেখাতাম যাতে ও নিয়মিত আসে।তাতে কাজও হয়েছিল।প্রায়ই আসত ও।আমাকে একাটা সুন্দর দুপুর উপহার দিত।যেদিন মাসুম আসত না আমার কাছে দিনটা অনেক লম্বা মনে হত।সেদিন আমি আপনাদের  গল্প-উপন্যাসের সেই কথার যথার্থতা পেতাম "দুঃখের প্রহর সুদীর্ঘ"।


এভাবেই চলছিল দিন।ইদের দিন সালেহা খালা দুদিনের জন্য আসবে না বলে স্বঘোষিত ছুটির ফরমান জারি করেন।আমার জন্য খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়।কিভাবে গরম করতে হয় তাও শিখিয়ে দিয়ে যায়।


ইদের পরের দিন সারাদিন আমি শুয়েই ছিলাম। বিকেলে একটু হাঁটতে বের হই।হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাড়ে গিয়ে বসে রই। সেখানে কিছু দম্পতি সন্তান নিয়ে, কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাঁটতে বের হয়।সেই সংখ্যাটা নেহায়েত অতি নগন্য।সেদিন আমি প্রথম অনুভব করছিলাম পৃথিবীটা যদি আমার একার হত। তাহলে আজকের এই সুন্দর সূর্যাস্তটা আমি নিরবে দেখে যেতে পারতাম।সেইদিনের সূর্যের রূপ বর্ণনা করবে এমন কবি-লেখক এই ধরাতে আছে আমার জানা নেই।আমি নিশ্চত আপনারা যদি সেদিনের সূর্যাস্ত দেখতেন তাহলে আপনারা শপথ করে বলতেন আমি সত্য বলেছি।সেদিনের আকাশ যেন সিঁদুর-চন্দনে মাখা ছিল।সেই আকাশ এত সুন্দর ছিল যে পাখিরা উড়তে ভুলে যায়।তারাও হয়ত আমার মত মুগ্ধ নয়নে দূরে কোথাও বসে আকাশ দেখছিল। সেদিন আকাশে আলো থাকতেই মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়।আমার এত সুন্দর আসমান রেখে আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না।আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমি যেন সূর্যের প্রতিবিম্ব।সে ছিল আমার মত নিঃসঙ্গ, তার ভিতরটাও জ্বলছিল আমার মত।তফাৎ শুধু সে উপরে আর আমি  নিচে।বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে বুঝলাম সূর্যটা আমার সঙ্গ পছন্দ করছে না।সে চলে গেল।আমিও উঠে আসলাম।ততক্ষণে পৃথিবী নিরব আঁধারে ঢেকে গেছে। 


আমি লেকের পাড় থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসলাম।রাস্তায় এসে দেখলাম অনেকগুলো কুকুর একসাথে ডাকাডাকি করছে।আমি একটু সাবধানী হয়ে ধীরে ধীরে সেগুলোকে অতিক্রম করি৷ হঠাৎ করে লোডশেডিং হল। ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না সেই রাস্তায়।কয়েক গজ যেতেই এক বিকট গন্ধে গা গুলিয়ে আসছিল।নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে চলতে লাগলাম।আর মনে মনে বলতে লাগলাম,

"মিউনিসিপ্যালের লোকজন কি সব ছুটিতে চলে গেছে নাকি?"


হঠাৎ করে অন্ধকার প্রকট হতে লাগল।ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল।প্রচণ্ড জোরে ঝড় বইতে লাগল।মনে হচ্ছিল অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে ঝড়ের লেজে পা ফেলেছি আর অমনি সে হুংকার ছেড়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে। ঝড়ের প্রতিটি ঝাপটায় আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠছিল।ইতোমধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিয়েছে।বৃষ্টির তীবতা দেখে মনে হচ্ছিল আকাশ ভেঙে এই বর্ষণ নেমেছে।যদিও আমি সব সময় বৃষ্টি আশা করি তবুও সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে মোটেও ভালো লাগছিল না। অন্ধকারের প্রকটতায় ল্যাম্পপোস্টের আলো ক্ষীণ হয়ে গেছে।সেই আলোতে আমি ছুটে যাচ্ছি।দেখা যাচ্ছে সামনের ল্যাম্পপোস্টে কোনো আলো নেই।আমি ভাবলাম এই অন্ধকারে দৌঁড় দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি সাধারণ গতিতে অন্ধকার পিছনে ফেলে আলোর দিকে যাচ্ছিলাম। 


হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে আকাশ গর্জে উঠে।সেই বিদ্যুতের আলোয় দেখি বৃষ্টিস্নাত ছায়ামূর্তি।তা যেন আরেক বিদ্যুৎ।যেই বিদ্যুৎ দীর্ঘদিন আমার হৃদয়কে তরঙ্গিত করেছে।আমার মনকে আলোড়িত করেছে।তার বর্ণনা দেয়ার মত যথেষ্ট শব্দ ভাণ্ডার আমার নেই।তাকে স্বর্গের হুর-পরীদের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।তার মুখ থেকে দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।হঠাৎ বিস্ফোরিত দ্যুতিতে আমি পলক ফেলতে ভুলে যাই।নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য স্বর্গের বাসিন্দা মনে হচ্ছিল।তার স্থির অথচ সজল চোখে আমার সবখানি যেন ডুবে যাচ্ছে।সেই চোখে সাত সমুদ্রের ঠাঁই হবে বিলীন হয়ে যাবে হাজারো নদী।আর  অন্ধকারে ঢাকা পুরো পৃথিবীতে তার বদনখানি মনে হচ্ছিল পূর্ণিমার চাঁদ।তোমাদের কেউ যদি সেদিনের এই দৃশ্য দেখতে তাহলে তোমরা,অমাবস্যার রাতে যদি কখনো চাঁদ দেখা যায় সেই পরিবেশের সাথে ঐদিনের খুব মিল খুঁজে পেতে। 

বৃষ্টিতে ভিজে তার শাড়িটা শরীরের সাথে লেপটে আছে।তার উন্মুক্ত গ্রীবায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মুক্তোর মত জ্বলছিল।তার কিছু চুল মুখের উপর রেখা একে দিয়েছে।সেই রেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সুন্দরতম বস্তুতে অবহেলার রেখা পড়েছে।আমার ইচ্ছে করছিল যত্ন করে চুলগুলো সরিয়ে দেই।যেই হাত বাড়িয়েছি অমনি ছুটে পালাল আর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।জানি না ঠিক কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।হঠাৎ বুকের ভিতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করলাম।নিশ্বাসের উষ্ণতা বেশ টের পাচ্ছিলাম।চোখ জ্বলতে লাগল।  


বাসায় এসে জামা বদলে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে থাকি।পরেরদিন দুপুরের পর ঘুম ভাঙে।প্রচণ্ড জ্বর এবং শরীর ব্যথায় মুখ দিয়ে অনিচ্ছাকৃত গোঙানি বের হচ্ছিল।  


এমন সময় বাহিরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে।সবাইকে বলি, "গল্প এইটুকুই শেষ।"

সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসি। মনের অজান্তে  দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠি,"গল্প এখানেই শুরু।"..


কলমে-

মারূফ বিন আবদেল আজিজ 

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.